দুই বছর আগে চাঁদার দাবিতে এক ব্যক্তিকে (৪৫) তুলে নিয়ে যান স্থানীয় ১০-১২ জন। পরে ওই ব্যক্তিকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে তা ভিডিও করে রাখা হয়। পরদিন সকালের মধ্যে দুই লাখ টাকা চাঁদা না দিলে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। চাঁদা দেওয়ার শর্তে নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারেন ব্যক্তিটি। তবে ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেল করার ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পরদিন সকালে নিজ বাড়ির বারান্দায় বিমের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। ঘটনাটি ঘটে ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায়।

ঘটনাটি ধর্ষণের হলেও, দেশের আইন সেটাকে ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেনি। ফলে ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে। দেশে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও আইনে পুরুষের যৌন হয়রানি নিয়ে সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ধর্ষণের সংজ্ঞায় যে গুরুতর ফাঁক রয়েছে, তার দিকে আইনপ্রণেতাদের নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন আইনজীবী ও গবেষকেরা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পরিচালক (কর্মসূচি) নিনা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণের সংজ্ঞাকে আরও বিস্তৃত করে জেন্ডার নিরপেক্ষ করতে হবে। যাতে সবার জন্য বিচার প্রযোজ্য হয়। সেই সঙ্গে লিঙ্গ ছাড়াও শরীরে অন্য কিছু প্রবেশ করাকেও ধর্ষণের সংজ্ঞায় ফেলতে হবে।

শ্রীপুরের ঘটনায় মামলাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে মারা যাওয়া ব্যক্তির ছেলে মামলার বাদী (২৩) বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি আর মা নানাবাড়িতে ছিলাম। বাবা ফোনে পুরো ঘটনা জানিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, “তুমি চিন্তা কোরো না। আমরা পুলিশের কাছে যাব।” কিন্তু বাবা নগ্ন ভিডিওর কারণে খুব ভেঙে পড়েছিল। পরদিন সকালে আত্মহত্যা করে।’

স্থানীয় কলেজে স্নাতক (পাস) কোর্সের শিক্ষার্থী ছেলেটি জানান, এ ধরনের ঘটনায় কোন ধারায় মামলা হবে, সে সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ওই সময় শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন ভুঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, পুরুষের ক্ষেত্রে ধর্ষণের মামলা হয় না বলে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে। ৮ জন আসামির দুজন কারাগারে। দুজন জামিনে, অন্যরা পলাতক।

 

৫ শতাংশ পুরুষ ধর্ষণের শিকার

২০১৩ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের বহু রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৫ শতাংশ পুরুষ ধর্ষণের শিকার হন। ১৮ বছরের নিচে ধর্ষণসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ৩৭ শতাংশ। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশের ১০ হাজার পুরুষ ও ৩ হাজার নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ২ হাজার ৪০০ পুরুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের পক্ষে গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলেন আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রুচিরা তাবাসসুম নভেদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যেসব দেশে যৌনতা নিয়ে কড়াকড়ি বেশি, ছেলেমেয়েদের আলাদা করে রাখা হয়, সেসব দেশে অনেক সময় যৌনতার প্রকাশ এভাবে ঘটে। এর বাইরে কিছু পুরুষ পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট থাকেন। সামাজিকভাবে এসব পুরুষের কিছু করার উপায় থাকে না বলে পুরুষ ধর্ষণের দিকে ঝোঁকেন। আবার নারী ধর্ষণের মতো পুরুষ ধর্ষণকেও একধরনের ‘বাহাদুরি’ বলে মনে করেন কিছু পুরুষ।

১ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তর ভাসানটেক থেকে শাহ আলম (৩৯) নামের এক ব্যক্তি হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তরুণ একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনেছেন।

ভাসানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার ঘটনায় একমাত্র আসামি রহমত উল্লাহ (১৮) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, শাহ আলম সমকামী ছিলেন। তাঁকে বিভিন্ন সময় যৌন নিপীড়ন করতেন। রহমতউল্লাহর দাবি অনুসারে, এর আগেও তিনি এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ কারণে ক্রোধ থেকে হত্যা করেছেন।

আইনে ফাঁক
দণ্ডবিধি ৩৭৫ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ৯ ধারা অনুসারে ধর্ষণের সংজ্ঞা হচ্ছে, নারী ও শিশুর প্রতি পুরুষের অপরাধ সংঘটন। কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের শিকার হলেও আইনের চোখে তা ধর্ষণ নয়। আবার দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাটি মূলত সমকামিতার অপরাধ হিসেবেই চিহ্নিত হয়।

অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় শিশুর বয়স ১৬ পর্যন্ত বিবেচনা করে। অথচ দেশের শিশু আইনে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সকে শিশু বলে ধরা হয়। ফলে ১৬ বছরের বেশি বয়সী এবং ১৮ বছরের নিচের বয়সী ছেলেরা ধর্ষণের শিকার হলেও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে বিচার পায় না।

আইনের বিভিন্ন ধারার ব্যাখ্যা দিয়ে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগের অ্যাডভোকেসি লিড তাকবির হুদা প্রথম আলোকে বলেন, আত্মহত্যা করা ওই ব্যক্তির ঘটনাটি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার বিচারহীনতার সাক্ষ্য হয়ে থাকবে। নারী ধর্ষণকে ধর্ষণের ‘স্বাভাবিক’ রূপ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তবে পুরুষ ধর্ষণ বাংলাদেশে এখন যে আর ‘অচিন্তনীয়’ কোনো ব্যাপার না, তা মেনে নেওয়ার সময় হয়েছে। মাদ্রাসাতেও ছেলে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অনেক ঘটনা ঘটছে।

দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন চেয়ে ১৪ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাসমিয়া নূহাইয়া আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ ও সমাজকর্মী সৌমেন ভৌমিক।

রিটটি পরিচালনা করেন আইনজীবী তাপস কান্তি বল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিটটি এখন শুনানির অপেক্ষায়। তিনি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা অনেক বেশি ঘটলেও, এটাকে ধর্ষণ বলে শনাক্ত করা হচ্ছে না। ৩৭৭ ধারায় ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ’ উল্লেখ করে দুই পুরুষের মিলিত হওয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার হয়েও উল্টো শাস্তি পাওয়ার ভয়ে অনেক পুরুষ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না।

লেখক: নাজনীন আখতার, ঢাকা।
সূত্র: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *