চেক ডিজঅনার মামলায় বৈধ কারণ প্রমাণে ব্যর্থ হলে আর সাজা নয়

হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনার মামলায় চেক প্রাপ্তির বৈধ কারণ প্রমাণে ব্যর্থ হলে চেক ডিজঅনার মামলায় কোনো ব্যক্তিকে সাজা দেয়া যাবে না। চেক ডিজঅনার মামলায় বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে এ যুগান্তকারী রায় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। 

লেখক: আকতারুজ্জামান আকতার

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার বিচারপতির সমন্বয়ে আপিল বিভাগ বেঞ্চ এ রায় প্রকাশ করেন।আদালতে আপিলকারীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী এবং প্রতিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ।

ঘটনার বৃত্তান্ত মতে, সামছি খানমের মালিকানাধীন নর্থ গুলশানের ৩০ কাঠা জমি ১৯৭৯ সালেরসেপ্টেম্বর সম্পাদিত ইজারা চুক্তি মূলে আমেরিকান দূতাবাসকে ১১ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। ওই ইজারা চুক্তি নিবন্ধন (রেজিস্ট্রি) হয়নি এবং বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে সামছি খানমের উত্তরাধিকারীরা (ইমরান রশিদ চৌধুরী, পারভেজ রশিদ চৌধুরী জিনাত রশিদ চৌধুরী) জমিটি বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আবুল কাহের শাহিন নামের এক ব্যক্তি ইমরান রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, জমিটির বাজারমূল্য ১৫০ কোটি টাকা যা তিনি এই মূল্যে  বিক্রি করে দিতে পারবেন বলে আশ্বাস দেন, এবং ঐ  আশ্বাসের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ১৩ মার্চ শাহিনের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুসারে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বাজারমূল্যে জমিটি বিক্রি করে দেওয়া এবং জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে শাহিন ১৩ শতাংশ টাকা পাবেন বলা হয়। তখন ইমরান রশিদ চৌধুরী নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ভবিষ্যতের তারিখ উল্লেখ করেকোটি ৫০ লাখ টাকার ৪ টি চেক আবুল কাহের শাহিন এর নামে ইস্যু করেন। কিন্তু ৯০ দিন পার হওয়ার পরও আবুল কাহের শাহিন বাজার মূল্যে উক্ত জমিটি বিক্রয় করতে ব্যর্থ হন। এতে চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়। ২০১২ সালের ১৬ আগস্ট জমিটির ইজারা গ্রহীতা আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে মালিকেরা বায়না চুক্তি করেন এবং পরবর্তীতে ২০১৩ সালেরজুলাই বিক্রয় পূর্বক দলিল করেন। অপরদিকে ইমরান রশিদ চৌধুরী উল্লিখিত চেকগুলো ফেরত দিতে  আবুল কাহের শাহিনকে বলেন কিন্তু আবুল কাহের শাহিন পোস্ট ডেটেড চেক চারটি ফেরত না দিয়ে চেক চারটি নগদায়নের জন্য ব্যাংকে উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে শাহিনকে দেওয়া চেকগুলো সম্পর্কে ইমরান রশিদ চৌধুরী ব্যাংকেস্টপ পেমেন্ট ইন্সস্ট্রাকশনদিয়ে রাখেন । ফলে চেকগুলো ডিজঅনার হয়। অবস্থায় শাহীন নিম্ন আদালতে চেক ডিজঅনারের মামলা করে তার পক্ষে রায় পান।

পরবর্তীতে ইমরান রশিদ চৌধুরী নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করেন ।হাইকোর্ট শুনানি নিয়ে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট ইমরানের আপিল মঞ্জুর করে রায় দেন। যেখানে মামলার অভিযোগ থেকে খালাস পান ইমরান রশিদ চৌধুরী। এর বিরুদ্ধে আবুল কাহের শাহিন আপিল বিভাগে আপিল করেন। এই আপিল খারিজ করে আপিল বিভাগ ওই রায় দেন। রায়ের শেষাংশে বলা হয়, যেখানে কোনো অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার/প্রতিশ্রুতি অন্য কোনো ঘটনা বা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল এবং এর ভিত্তিতে যদি প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানের জন্য কোনো চেক প্রদান করা হয়, কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা না হয় সে ক্ষেত্রে চেক প্রদানকারীর ওপর চেকে উল্লেখিত অর্থ প্রদানের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। চেক গ্রহীতার পক্ষে চেকে উল্লেখিত ওই অর্থ দাবি করার অধিকার তৈরি হবে না। 

যেই কারণে বিবাদীর (ইমরান রশিদ চৌধুরী) অর্থ প্রদান বন্ধের নির্দেশনা অসততা বা প্রতারনা বলে গণ্য হবে না। ফলে বিবাদীকে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ এর  ১৩৮ ধারার অধীন সংঘঠিত অপরাধে শাস্তির প্রশ্ন আসে না। যে কারণে আপিল বিবেচনার দাবি রাখে না। তাই আপিল খারিজ করা হলো। 

চেক ডিজঅনারের মামলার ক্ষেত্রে আগে চেকদাতার দায় এড়ানোর সুযোগ খুবই কম ছিল। চেকগ্রহীতার টাকা পাওয়ার কোনো বৈধ কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হতো না, এ রায়ের ফলে তা খতিয়ে দেখার সুযোগ তৈরি হলো। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যদি দেখা যায় চেকটি দেওয়ার কোনো বৈধ কারণ নেই বা চেক দেওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা পূরণ হয়নি, তাহলে চেকের উপর চেক গ্রহীতার অধিকার জন্মাবে না। এমন ক্ষেত্রে চেক ডিজঅনার হলে চেকদাতাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।

উদাহরণ সরূপ, ‘ক’ এবং ‘খ’ এর মধ্যে এই মর্মে চুক্তি হয় যে , ‘ক’ এর একটি জমি ‘খ’ ৯০ দিনের মধ্যে ১ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিলে ‘খ’ দুই লক্ষ টাকা কমিশন বাবদ ‘ক’ এর নিকট হতে প্রাপ্ত হবেন । যার নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ভবিষ্যতের তারিখ উল্লেখ করে ‘ক’ এর নিকট হতে দুই লক্ষ টাকার একটি চেক ‘খ’ প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে ‘খ’ জমি বিক্রি করতে ব্যর্থ হলে ‘খ’ পূর্বে গৃহীত চেকটি ‘ক’ কে আর ফেরত না দিয়ে পূর্বে উল্লিখিত তারিখে নগদায়নের জন্য চেকটি ব্যাংকে উপস্থাপন করেন অপরদিকে ‘ক’ উক্ত চেকটির ব্যাপারে আগেই ব্যাংকে স্টপ পেমেন্ট দিয়ে রাখেন যার কারণে চেকটি ডিজঅনার হয়। পরবর্তীতে ‘খ’ এন আই অ্যাক্ট এর ১৩৮ ধারায় ‘খ’ এর বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার এর মামলা করেন। সেই ক্ষেত্রে আগে চেক দাতাকে সরাসরি ১৩৮ ধারায় উক্ত টাকার জন্য দায়ী করা যেত, বৈধ লেনদেন বা চুক্তি প্রমানের দরকার হতো না কিন্তু নতুন এই রায়ের ফলে প্রমান করতে হবে যে, চেক দাতা এবং চেক গ্রহিতার মধ্যে বৈধ লেনদেন বা চুক্তি ছিল, তা প্রমানিত না হলে চেকদাতাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।

নতুন এই যুগান্তকারী রায়কে আমরা সাধুবাদ জানাই, আশা করি এই রায়ের মাধ্যমে চেক দাতা  আগে যেসব ভোগান্তির স্বীকার হতো এখন থেকে সেই সব ভোগান্তির অবসান ঘটবে ।

লেখক: আকতারুজ্জামান আকতার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *